নাসা এবং United Launch Alliance মিলে উৎক্ষেপণ করল সবচেয়ে দ্রুতগামী মহাকাশযান পার্কার সোলার প্রোব। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই স্পেসপ্রোবটি যাত্রা করে সূর্যের দিকে। সম্মিলিত উৎক্ষেপণ জোট বা ইউএলএ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মহাকাশে যান উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অভিজ্ঞ। এই কোম্পানির রয়েছে একাধারে ১২০টি উৎক্ষেপণ পরিচালনা করার রেকর্ড এবং উৎক্ষেপণে ১০০% সফলতা। এ প্রকল্পটির আর্থিক খরচ ১.৫ বিলিয়ন ডলার।
মহাকাশযানটি গতকাল (১১ই আগস্ট ২০১৮) উৎক্ষেপণের কথা ছিল, কিন্তু উৎক্ষেপণের শেষ মিনিটে ত্রুটি ধরা পড়ায় সময় পিছিয়ে দেয়া হয়। উৎক্ষেপণের নতুন সূচি ঠিক করা হয় আজ রবিবার (১২ আগস্ট ২০১৮) ফ্লোড়িডার কেপ ক্যানাভারালের স্থানীয় সময় রাত ৩:৩১ এ। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সময় দুপুর ১টা ৩১ মিনিটে এর উৎক্ষেপণের সম্ভাব্য সময় এটি উৎক্ষেপিত হয়েছে। পার্কার সোলার প্রোব উৎক্ষেপণের ভিডিও অবলোকন করা যাবে এখানে।
এই প্রোবকে মহাকাশে নিয়ে গেছে ইউএলএ এর শক্তিশালী রকেট ডেল্টা IV। আর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৪ এর ডিসেম্বরে পার্কার সোলার প্রোব হবে ইতিহাসের দ্রুততম মহাকাশযান। এ ঘটনাটি ঘটবে যখন প্রোবটি সূর্যের সবচেয়ে কাছে পৌঁছুবে। এ অভিযানের রূটম্যাপ বলছে এটি সূর্য থেকে ৩.৮৩ মিলিয়ন মাইল (৬ মিলিয়ন কিলোমিটার) দূর দিয়ে যাবে। ঐ বিন্দুতে গিয়ে প্রোবটির গতি হবে ৬৯২,০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। অর্থাৎ সেকেন্ডে ১৯২ কিলোমিটারেরও বেশি।
এ দূরত্ব কত বড় আন্দাজ করতে পৃথিবীর সাথে তুলনা করে দেখা যেতে পারে। এই গতিতে প্রোবটির ওয়াশিংটন ডিসি থেকে টোকিওতে যেতে ১ মিনিটেরও কম সময় লাগত। আর টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া যেতে চার সেকেন্ডের চেয়ে একটু বেশি সময়!

পার্কার স্পেসপ্রোবের পেছনে কাজ করা দলটি অবশ্য নির্বিকার এই রেকর্ডভাঙা কাজে। তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ অভিযানের খুঁটিনাটিতে। এই প্রজেক্টের ম্যানেজার এন্ড্রু ড্রিসম্যান নিযুক্ত আছেন জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ল্যাবরেটরিতে। তিনি বলেন, “মহাকাশে কোনো কিছু দ্রুতবেগে ছোটার জন্য সেটার ডিজাইন করা যতটা কঠিন তেমনি ধীরে ছোটার ডিজাইন করাও সমান মাত্রার কঠিন। কারণ হল, মহাশূন্যে তো একটা চালু দশাকে ঠেকানোর মত কিছু নেই।”
এ ব্যাপারগুলো অরবিটাল মেকানিক্সে ধারণা থাকলে খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। গতি বাড়ানো যেমন সমস্যা, তেমনি মহাকাশযান টিকিয়ে রেখে এমন গতিপথ বাছাই করাও সমস্যা যা ঐ গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহাকর্ষের আকর্ষণে বিচ্যুত হওয়া থেকে রক্ষা করবে। উল্লেখ্য মহাকাশে কোনো মহাকাশযানের গতিবৃদ্ধির এখনো পর্যন্ত সেরা উপায় হল কোনো গ্রহের বা সূর্যের মাধ্যাকর্ষণক্ষেত্রকে কাজে লাগানো। ড্রিসম্যান অবশ্য মজা করে বলেন, “মহাকাশযান কেবল জানে না এটি যে দ্রুতগতিতে ছুটছে।”

যাই হোক, এটা যে নিতান্ত ঝামেলাবিহীন অভিয়ান নয় তা স্পষ্ট। স্পেসপ্রোব না জানলেও, বিজ্ঞানীদের ঠিকই স্পেসপ্রোবকে সম্মুখীন হতে হবে এমন বিবিধ পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখতে হয়। পার্কার সোলার প্রোব অতিদ্রুতবেগে ছোটার সাথে হিসেবে রাখতে হচ্ছে কোন মহাকাশীয় পরিবেশের মধ্য দিয়ে এটি গমন করছে। এটির অভিযানপথে রয়েছে এমন ধুলোময় পরিবেশ যাকে বলা হয় হাইপারভেলোসিটি ডাস্ট এনভায়রনমেন্ট। অর্থাৎ, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বহু ধুলিকণাময় পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাবে পার্কার।
হাইপারভেলোসিটি অর্থাৎ উচ্চগতি বলতে প্রচলিতভাবে ধরা হয় ৩ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড বেগকে। এই বেগের ফলে দ্রুত ছোটা কণাগুলোর ভরবেগও যথেষ্ঠ মাত্রায় বেশি। ফলে এরা প্রবল ভরবেগে আঘাত করবে পার্কার সোলার প্রোবকে যার কারণে প্রোবের বেগের দিক বিদিকও হয়ে যেতে পারে। আসলে মহাকাশে অল্প আঘাতই বিশাল দূরত্বে ছোটা বস্তুর জন্য যথেষ্ঠ দিক বিদিকের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। এ সমস্যা নিরসণে বিজ্ঞানীরা স্পেসক্রাফটে ব্যবহার করবেন কেভলার কম্বল। এ বিশেষ কম্বল অধিক তাপসহ আর সিন্থেটিক ফাইবারের তৈরি। এ ধরণের ফ্যাব্রিকের বহুল ব্যবহার রয়েছে বুলেট প্রতিরোধী জ্যাকেট, শরীরের বর্ম, বোমার চাদর ইত্যাদি নির্মাণে। অর্থাৎ এই সমাধান বহু আঘাতে টেকসই থাকার সুবিধা দিতে পারছে।
শুক্রের অভিকর্ষকেও পার্কার সোলার প্রোব কাজে লাগাবে। শুক্রের কাছ দিয়ে পার্কার সোলার প্রোব ৭ বার অতিক্রম করবে। সূর্যের দিকে পাঠিয়ে সূর্য ওপাশ দিয়ে প্রোবকে ফেরত আনার চ্যালেঞ্জও রয়েছে। পৃথিবী নিজেই সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার বেগে দৌড়াচ্ছে, সে অনুসারে এই আদিবেগ পেয়ে যাচ্ছে প্রোব। কিন্তু এটি সূর্যের দিকের সাথে সমকোণে হলে পথ বেঁকে বড় হয়ে যাবে। ফলে সময় লাগবে আরো বেশি, উদ্দিষ্ট লক্ষ্যও টিকবে না। বেগ সংক্রান্ত সমস্যা বুঝতে দেখতে পারেন এই ভিডিওটি।
অভিযানের পথ অনুযায়ী, পার্কার সোলার প্রোব যখন সূর্যের সবচেয়ে নিকট বিন্দু দিয়ে যাবে তখন এর বেগ হবে ভয়েজার ১ এর বেগেরও দশগুণের বেশি। ভয়েজার ১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল ১৯৭৭ এ, পাঁচ বছর আগে এটি সৌরজগতের বাইরে চলে গিয়েছে। প্রক্সিমা সেন্টরাইয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঘণ্টায় ৬১,০০০ কিলোমিটার বেগে।

স্বাভাবিক হিসেবে গতি অর্জনের কৌশলের দিক থেকে ভয়েজার ১-ই ইতিহাসখ্যাত। তবে ২০১৬ এর জুলাইতে নাসার জুনো প্রোব বৃহস্পতির অভিকর্ষের প্রভাবে কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে বৃহস্পতির গ্যাসীয় জমিনে পড়ে ধ্বংস হয়। তখন এর বেগ পৌঁছে গিয়েছিল ঘণ্টায় ২৬৬,০০০ কিলোমিটারে। এ গতিবেগ কাজে না লাগলেও কতদূর অর্জনযোগ্য এটার একটা নমুনা পাওয়া গিয়েছিল।
পার্কার সোলার প্রোব দৃশ্যমান সৌরপৃষ্ঠ থেকে চার মিলিয়ন মাইল (৬.৪ মিলিয়ন কিলোমিটার) নিকট দিয়ে যাবে। ফলে হেলিওসের চেয়েও প্রায় তিনগুণ বেগে দৌঁড়াবে এটি। সূর্যের উত্তাপকে আরেক ধাপ এগিয়ে চ্যালেঞ্জ জানানোর পথে অভিযাত্রা শুরু হয়ে গেছে… গতি অর্জন মানে তো আমাদের স্বপ্নে আশার সঞ্চার… বহুদূর ছুটে যেতে।
তথ্যসূত্র:
- https://www.space.com/41447-parker-solar-probe-fastest-spacecraft-ever.html
- https://www.theguardian.com/science/2018/aug/10/mission-to-touch-the-sun-nasa-to-launch-parker-solar-probe
- https://blogs.scientificamerican.com/life-unbounded/the-fastest-spacecraft-ever/
- https://www.space.com/41461-parker-solar-probe-launch-delayed.html
- https://voyager.jpl.nasa.gov/mission/status/