মারিয়ানা ট্রেঞ্চ একটি অর্ধচন্দ্রাকার খাঁদ, যা পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়াম অঞ্চলের মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের কাছে অবস্থিত। এর আশাপাশের পরিবেশ কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম খাঁদটি মারিয়ানা ট্রেঞ্চে অবস্থিত। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের দক্ষিন অংশের নাম হচ্ছে চ্যালেঞ্জার ডিপ এবং এটিই মহাসাগরের সবচেয়ে গভীরতম বিন্দু। এর একদম সঠিক গভীরতা নির্ণয় করা একটু কষ্টসাধ্যই বটে, কিন্তু আধুনিক পরিমাপক দ্বারা নিখুঁত মাপ পাওয়া না গেলেও অনেকাংশে সঠিক পরিমাপ বের করা সম্ভব হয়েছে।

২০১০ সালে চ্যালেঞ্জার ডিপের গভীরতা ৩৬,০৭০ ফিট (১০,৯৯৪ মিটার) পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছিল শব্দের কম্পন/প্রতিধ্বনি দ্বারা এবং জরিপটি করেছিল National Oceanic and Atmosphere Administration (NOAA)। বিখ্যাত মুভি ডিরেক্টর জেমস ক্যামেরন ২০১২ সালে তার গভীর সমুদ্রের অভিযান হিসাবে চ্যালেঞ্জার ডিপের উদ্দেশ্যে গমন করেন এবং তিনি ৩৫,৭৫৬ ফিট (১০,৮৯৮ মিটার) পর্যন্ত পৌঁছান। ২০১৪ সালে ইউনিভার্সিটি অফ হ্যাম্পশায়ারের কিছু গবেষক সমুদ্রের তলদেশের একটি মানচিত্র প্রকাশ করেন এবং চ্যালেঞ্জার ডিপ ৩৬,০৩৭ ফিট (১০,৯৮৪ মিটার) বলে ঘোষণা দেন। মহাসাগরের দ্বিতীয় গভীরতম স্থানটিও মারিয়ানা ট্রেঞ্চেই অবস্থিত যার নাম দ্য সিরেনা ডিপ। এটি চ্যালেঞ্জার ডিপ থেকে ১২৪ মাইল (২০০ কিলোমিটার) পূর্বে অবস্থিত এবং ৩৫,৪৬২ ফিট (১০,৮০৯ মিটার) গভীর। যদি মাউন্ট এভারেস্টের সাথে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তুলনা করা হয় তাহলে মাউন্ট এভারেস্ট অনায়াসে হেরে যাবে। কারণ মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ২৯,০২৯ ফিট, আর অপর দিকে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ ৩৬,০৭০ ফিট গভীর। ফলে এভারেস্টকে যদি মারিয়ানা ট্রেঞ্চে নিমজ্জিত করা হয় তাহলে তার চূড়ারও খোঁজ পাওয়া যাবে না।

রক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ ১,৫৮০ মাইল (২,৫৪২ কিলোমিটার) দীর্ঘ যা ৫ টি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চাইতেও বড় কিন্তু প্রস্থে মাত্র ৪৩ মাইল (৬৯ কিলোমিটার)। যেহেতু গুয়াম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আওতাধীন এবং ১৫ টি মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের কমনওয়েলথের সাথে যুক্ত তাই আইনগতভাবে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীন। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিও বুশ মারিয়ানা ট্রেঞ্চকে জাতীয় সামুদ্রিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে ঘোষণা দেন। যার ফলে ১,৯৫,০০০ বর্গ মাইল (৫,০৬,০০০ বর্গ মিটার) পর্যন্ত সমুদ্রের তলদেশে এবং পানির চারপাশের বিছিন্ন দ্বীপগুলো সুরক্ষিত সামুদ্রিক রিজার্ভের আওতায় পড়ে যায়। এর মধ্যে মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের বেশীরভাগ দ্বীপ এবং পানির নিচের ২১ টি আগ্নেয়গিরিও অন্তর্ভুক্ত।
কিভাবে তৈরি হয়েছিল এই খাঁদ?
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ তৈরি হয়েছিল এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যা সাবডাকশন বলয়ে ঘটে থাকে। (নোটঃ সাবডাকশন বলয় হচ্ছে এককেন্দ্রমুখি প্লেট, যেখানে অন্তত একটি টেকটনিক প্লেট হচ্ছে সামুদ্রিক ভূ-ত্বকের।) সাবডাকশন বলয়ে একটি সামুদ্রিক প্লেটকে অপর প্লেটের সাথে চাপ দেওয়া হয়, ফলে একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের নিচে চলে যায় এবং সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। যেখানে এই সংঘর্ষটি হয় সেখানে বিশাল খাঁদের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে প্রশান্ত মহাসাগরের প্লেটটি ফিলিপাইনের প্লেটের সাথে চাপ লেগে বেঁকে যাচ্ছে। খাঁদ গভীর হলেও সেটা যে পৃথিবীর কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকবে এমনটা কিন্তু নয়। যেমন ইকুয়েটর অঞ্চলে পৃথিবী হচ্ছে স্ফীত আর মেরু অঞ্চলের প্লেট পৃথিবীর কেন্দ্রের কাছাকাছি, তাই চ্যালেঞ্জার ডিপ গভীর হলেও তা কিন্তু পৃথিবীর কাছাকাছি নয়।খাঁদের তলদেশে পানির চাপ অত্যাধিক বেশি, প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে প্রায় ৮ টন (৭০৩ কিলোগ্রাম প্রতি বর্গ মিটারে)। এটি সমুদ্রের পৃষ্ঠের চাপের চাইতে প্রায় ১০০০ গুন বেশি বা, ৫০ টি জাম্বো জেট প্লেন একজন মানুষের উপর স্তুপ করে রাখার সমান।

অস্বাভাবিক আগ্নেয়গিরি সমূহ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সারিবদ্ধ যেসব আগ্নেয়গিরি সমুদ্রের উপর মাথা তুলে আছে তারাই অর্ধচন্দ্রাকৃতির মারিয়ানা দ্বীপের সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও সমুদ্রের নিচে কিছু অদ্ভুত আগ্নেয়গিরি দেখা যায়, যেমন – এইফুকু সমুদ্রগর্ভস্থ আগ্নেয়গিরি তরল কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত করে। যে তরল এখান থেকে বের হয়ে আসে তার তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দাইকোকু সমুদ্রগর্ভস্থ আগ্নেয়গিরি বিগলিত সালফার নির্গমন করে, যা আর পৃথিবীর কোথাও দেখেতে পাওয়া যায় না।
খাঁদে যাদের বসবাস
সাম্প্রতিক কিছু অভিজানের পর অবাক করে দেওয়া বিচিত্র জীবনযাত্রার খোঁজ পাওয়া গেছে খাঁদের কঠিন পরিবেশে। যেসকল জীব মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীর অঞ্চলে বসবাস করে তারা অত্যাধিক চাপ এবং নিকষ কালো অন্ধকারে থাকে। মারিয়ানা ট্রেঞ্চে খাবার খুবই সীমিত, কারণ পানির উপরিভাগের খাবার এত গভীরে পৌঁছাতে পারে না। তাই পানির নিচে জীবাণু ও ছোট প্রাণীরা রাসায়নিক পদার্থ, যেমন: মিথাইন বা সালফার এর ওপর নির্ভর করে থাকে। সাধারণত তিন ধরণের জীব দেখা যায় মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে, সেগুলো হল – জেনোফাইওফোরস, অ্যাম্ফিপডস এবং সি কিউকাম্বার।

জেনোফাইওফোরস হচ্ছে এককোষী কিন্তু বৃহৎ আকারের অ্যামিবা এবং তারা আশেপাশে যা পায় তাই খায়। অ্যাম্ফিপড হচ্ছে চকচকে কিছুটা চিংড়ি মাছের মতো দেখতে এবং তারা ময়লা আবর্জনা খেয়ে বেঁচে থাকে। এদেরকেই মূলত খাঁদে বেশি দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা দুইশতাধিক বিভিন্ন ধরণের অনুজীবের সন্ধান পেয়েছেন সেখান থেকে কাদা তুলে আনার পর। এছাড়াও ২০১২ সালের জেমস ক্যামেরন এর অভিযানের সময় বিজ্ঞানীরা মাইক্রোবায়াল ম্যাট সনাক্ত করেন চ্যালেঞ্জার ডিপে। মাইক্রোবায়াল ম্যাট হাইড্রোজেন এবং মিথাইন শোষণ করে বেঁচে থাকে। সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে থাকা কিছু অদ্ভুত ধরণের মাছও এখানে দেখতে পাওয়া যায় এবং এরাই কিন্তু এখানে খাদ্য শিকল এর উপরের স্তরে রয়েছে। এই সকল জীব সাধারণত ২৬,২০০ ফিট (৮,০০০ মিটার) গভীরে দেখতে পাওয়া যায় যেখানে সূর্যের আলো একদমই পৌঁছায় না। এ কারণেই এরা দেখতেও অদ্ভুত এবং এদের শারীরিক কাঠামোও আলদা।
এই গভীরেও রয়েছে দূষন
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এই গভীর খাঁদেও পাওয়া গেছে মানুষের তৈরি দূষণের চিহ্ন। ১৯৭০ সালে যে সকল ক্ষতিকর রাসায়নিক নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল তা এখনো সমুদ্রের গভীরতম অংশে ওঁত পেতে আছে। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ থেকে নিয়ে আসা অ্যাম্ফিপড পরীক্ষা করার সময় একদল বিজ্ঞানী এরমধ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিকের অস্তিত্ব খুঁজে পান। এই সব রাসায়নিক ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ব্যবহার হয়েছিল এবং পরে তা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।
“এত গভীর এবং এত দুর্ভেদ্য অঞ্চলে মানুষের তৈরি অতিমাত্রার দূষণ খুঁজে পাওয়া খুবই দুঃখজনক এবং এটার একটা বিধ্বংসী প্রভাব পড়বে সমগ্র মানবজাতির উপরে দীর্ঘ সময়ের জন্য” বলে মন্তব্য করেন নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লেখক জেইমসিন।
গবেষকরা বলছেন যে, পরবর্তী ধাপ বুঝে কাজ করতে হবে এবং আগে যা কিছু হয়েছে তার ফলাফলের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ এটি আমাদের বাস্তুতন্ত্রের একটি অংশ।
featured image: eoimages.gsfc.nasa.gov